মুক্তিকালে জীবের অবস্থান: আত্মার মুক্তি ও মোক্ষের গুরুত্ব

"মোক্ষের গুরুত্ব: বৈদিক শাস্ত্রের আলোকে জীবাত্মার মুক্তি, ব্রহ্মের সঙ্গে সম্পর্ক ও আত্মার প্রকৃত স্বরূপের বিশ্লেষণ।"

 ও৩ম্ 

মুক্তিকালে জীবের অবস্থান: আত্মার মুক্তি ও মোক্ষের গুরুত্ব, পুনর্জন্ম থেকে মুক্তির উপায়, বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে মুক্ত জীব আত্মার প্রকৃত স্বরূপ

মোক্ষের গুরুত্ব: বৈদিক শাস্ত্রীয় প্রমাণের আলোকে

মোক্ষ হল জীবাত্মার মুক্তি, যা জীবন চক্রের পুনর্জন্মের শৃঙ্খলা থেকে মুক্তির প্রতীক। বৈদিক দর্শন মোক্ষকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে। এটি আত্মার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি এবং সর্বশক্তিমান ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতার মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়। মোক্ষের গুরুত্বকে বৈদিক শাস্ত্র আচার্যদের মতামত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

. মোক্ষের প্রকৃতি জীবের অবস্থান

বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী, মোক্ষ প্রাপ্তির পর জীবাত্মা তার নিজস্ব স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্রহ্মের আনন্দ উপভোগ করে। জীব ব্রহ্ম হয়ে যায় না, নষ্টও হয় না, বরং নিজস্ব রূপে স্থিত হয়ে ব্রহ্মের সাথে এক ধরনের আনন্দময় সম্পর্ক গঠন করে।

প্রমাণ:

  • বেদান্ত (সম্পদ্যাবির্ভাবঃ স্বেনশব্দাৎ। বে ০৪//):
এই মন্ত্র থেকে বোঝা যায়, জীব মুক্তি লাভ করার পর নিজের প্রকৃত স্বরূপে ফিরে আসে। এটি বুঝিয়ে দেয় যে মোক্ষের মাধ্যমে জীব তার নিজের আধ্যাত্মিক গুণাবলীতে সম্পূর্ণতা পায়।

  • "এষ সম্প্রসাদোऽস্মাচ্ছরীরাত্ সম্থায পরম্ জ্যোতিরূপ-সম্পদ্য স্বেন রূপেণাভিনিষ্পদ্যতে" ছান্দোগ্য উপনিষদ (//):
এখানে বলা হয়েছে, মুক্তির পরে জীব পরম জ্যোতিতে প্রবেশ করে এবং নিজের প্রকৃত রূপে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, মুক্তিতে আত্মা তার প্রকৃত অবস্থায় ফিরে আসে এবং ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত হয়, কিন্তু ব্রহ্মে বিলীন হয় না।

. মুক্ত জীবের স্বাভাবিক শক্তি

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মতে, মুক্ত জীব তার স্বাভাবিক শক্তি দ্বারা কর্ম করে। তিনি তার "সত্যার্থপ্রকাশ" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে জীবের ২৪টি স্বাভাবিক শক্তি রয়েছে, যা মুক্ত অবস্থায় পুরোপুরি কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে মুক্ত জীব তার নিজস্ব ক্ষমতা এবং ব্রহ্মের আনন্দ উপভোগ করে।

প্রমাণ:

  • মুক্তঃ প্রতিজ্ঞানাৎ (বে ০৪//):
মুক্ত অবস্থায় জীব সাধারণ জীবের তুলনায় অধিক ঐশ্বর্য ক্ষমতা লাভ করে।

. আত্মার প্রকৃতি মুক্তির পর আত্মার গন্তব্য

আত্মা কোনও ভৌতিক জ্যোতিতে নয়, বরং পরমাত্মার জ্যোতিতে প্রবেশ করে। এটিই মুক্তির মাধ্যমে আত্মার সর্বোচ্চ গন্তব্য।

প্রমাণ:

  • আত্মা প্রকারণাৎ (বে ০৪//):
এখানে আত্মার প্রকৃতি নিয়ে বলা হয়েছে যে, মুক্তিতে আত্মা এমন একটি জ্যোতিতে প্রবেশ করে যা ভৌতিক নয়, বরং পরমাত্মার নিজস্ব জ্যোতি।

. মুক্তিতে জীব ব্রহ্মের সম্পর্ক

মুক্ত অবস্থায় জীব ব্রহ্মের সঙ্গে থাকে, তবে প্রকৃতির সঙ্গে নয়। এর মানে, মুক্ত জীব ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হয়, তবে তার নিজস্ব সত্তাকে হারায় না। শঙ্কর আচার্যের মতো কেউ কেউ জীব ব্রহ্মের একাত্মতা বা "অদ্বৈত" তত্ত্ব প্রচার করেছেন, তবে জৈমিনির মতে, মুক্ত জীব ব্রহ্মের আনন্দ উপভোগ করে কিন্তু ব্রহ্মে সম্পূর্ণ বিলীন হয় না।

প্রমাণ:

  • অবিভাগেন দৃষ্টত্বাৎ (বে ০৪//):
এই মন্ত্রে বলা হয়েছে, মুক্ত জীব ব্রহ্মের সাথে থাকে এবং তার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে। তবে ব্রহ্মে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় না।

  • সমাধান-ব্রাহ্মণে জৈমিনিরূপন্যাসাধিভ্যঃ। (বে ০৪//):
জৈমিনি আচার্য বলছেন যে, মুক্ত জীব ব্রহ্মের সঙ্গে সমান নয়, তবে তার আনন্দ জ্ঞানকে উপভোগ করে। এটি স্পষ্ট করে দেয় যে মোক্ষ জীবকে ব্রহ্মের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ দেয়, কিন্তু তা ব্রহ্মের সঙ্গে মিলে যায় না।

উপসংহার:

মোক্ষের গুরুত্ব বৈদিক শাস্ত্র এবং উপনিষদে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। মোক্ষ শুধুমাত্র পুনর্জন্মের বন্ধন থেকে মুক্তি নয়, এটি জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ব্রহ্মের পরম আনন্দ ভোগ করার মাধ্যম। ব্রহ্মের সাথে জীবের এই সম্পর্ক কোনও একাত্মতা নয়, বরং এক প্রকার চিরস্থায়ী আনন্দের ভাগাভাগি।


About the author

অমৃতের পুত্র
The true seeker of Sanatan Dharma does not chase the divine in temples alone, but finds God in truth, in duty, and in the silence of the soul.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন