ধর্ম ও বিজ্ঞান এর সমন্বয়
ধর্ম ও বিজ্ঞান এর সমন্বয়ের সমস্যা আজকের জটিল
সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি বিজ্ঞানের যুগ, যাকে ধর্মের সাথে বিরোধী হিসেবে মনে
করা হয়। আমাদের ভারতের সংবিধানে এই রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষিত করা হয়েছে। এর
অর্থ সাধারণত এটিই বোঝানো হয় যে এটি ধর্মহীন রাষ্ট্র, যদিও আমাদের মহামান্য প্রথম
রাষ্ট্রপতি স্বর্গীয় ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ রাধাকৃষ্ণণ
প্রায়শই বলেছেন যে সেক্যুলার স্টেট এর অর্থ ধর্মহীন রাষ্ট্র নয়, বরং
অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র যেখানে ধর্ম, মত, সম্প্রদায়ের পার্থক্য ছাড়াই সকলকে
উন্নতির সমান সুযোগ দেওয়া হবে। এটি দুঃখজনক যে সমাজতন্ত্র এবং বিশেষত সাম্যবাদ
(কমিউনিজম) এর ধর্মবিরোধী ও নাস্তিকবাদী প্রচারের কারণে অনেক যুবক-যুবতী ধর্মবিমুখ
হচ্ছে। এই অধ্যায়ে আমরা এই সমস্যার ওপর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব।
- ধর্মের লক্ষণ কী? বিশেষত বেদ অনুযায়ী ধর্ম কাকে বলে? এর অন্যান্য আর্য শাস্ত্রে উল্লেখিত লক্ষণগুলি কী?
- ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ আছে কি? আত্মা, পরমাত্মা, পুনর্জন্ম, প্রার্থনা, যজ্ঞ ইত্যাদি ধর্মের মূল উপাদানগুলির সাথে বিজ্ঞান বিরোধী কি?
- বেদ শুধুমাত্র ধর্মের মূল উৎস নাকি বিজ্ঞানেরও? যদি তাতে বিজ্ঞানেরও মূল থাকে এবং ধর্মেরও, তাহলে বৈদিক ধর্মে এই দুইয়ের বিরোধ কেনই বা থাকবে?
- ধর্ম ও মত বা সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য কী? খ্রিস্টান মত, ইসলাম, পৌরাণিক, জৈন এবং অন্যান্য মতবাদগুলির সাথে বিজ্ঞানের সমন্বয় আছে নাকি বিরোধ? এই বিষয়ে ইতিহাস কী সাক্ষ্য প্রদান করে?
- সত্যিকারের ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠায় কোনো কঠিনতা আছে কি? যদি থাকে, তাহলে কী এবং কীভাবে এটি দূর করা যেতে পারে?
ধর্মের লক্ষণ
শাস্ত্রকারগণ ধর্মের বহু লক্ষণ বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ
করেছেন, যেগুলির মধ্যে নিম্নোক্ত উদাহরণ যথেষ্ট হবে। মহাভারতে মহর্ষি বেদব্যাস ধর্ম
শব্দের অর্থ ও লক্ষণ নিম্নরূপ বলেছেন---
“धारणाद् धर्म इत्याहुर्धर्मो धारयते प्रजाः।
यस्माद् धारणं संयुक्तं स धर्म इति निश्चियः॥”
(মহাভারত ৮ |৬৯)
ধারণ করার কারণে তাকে ধর্ম বলা হয়। যে ব্যক্তি, পরিবার,
সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র পৃথিবীকে ধারণ করে, এই প্রকার সমস্ত প্রজাকে যে ধারণ করে,
তাকেই ধর্ম বলে। এটা নিশ্চিত।
‘ধর্ম’ শব্দটি ‘ধৃ’ (ধারণ করা) এই ধাতু থেকে এসেছে—
“अर्तिस्तु-सुहुसृ-धृक्षि-क्षुभायावा-पदियक्षिनीप्यो मन्॥”
(উণাদি সূত্র ১৮০)
এই সূত্র অনুসারে এর অর্থ হলো যে ধারণ করে। এটা ধর্মের
অত্যন্ত ব্যাপক অর্থ, যা সর্বদা স্মরণীয়। এর ভিত্তিতে অগ্নি, জল, বায়ু, বিদ্যুৎ
ইত্যাদির ধারণকারী গুণগুলোও ধর্ম নামে পরিচিত।
এই ধর্মের লক্ষণ ও স্বরূপকে মনে রেখে তৈত্তিরীয় আরণ্যকের
ঋষি বলেছেন—
“धर्मो विश्वस्य जगतः प्रतिष्ठा लोके धर्मिष्ठं प्रजा उपसर्पन्ति।
धर्मेण पापमय नुदन्ति, धर्मे सर्वे प्रतिष्ठितं,
तस्माद् धर्मः परमं वदन्ति॥”
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক)
অর্থাৎ, ধর্ম হলো সমগ্র বিশ্বের ভিত্তি এবং প্রতিষ্ঠা।
সমাজে ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির নিকট সমস্ত প্রজারা আসে। ধর্মের দ্বারা মানুষ পাপকে
বিনষ্ট করে এবং তাকে দূর করে। ধর্মেই সমস্ত কিছু প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং ধর্মকে ‘পরম’
বা সবচেয়ে বড় জিনিস বলা হয়। এখানে যে কথা বলা হয়েছে—“धर्मो विश्वस्य जगतः प्रतिष्ठा,
धर्मे सर्वे प्रतिष्ठितम्,” এর ভিত্তি বেদে নিম্নরূপ উক্তিতে পাওয়া যায়—
“विश्व॒स्व॑मा॒तर॒मोष॑धीनां ध्रुवां भूमिं पृथिवीं धर्मणा धृताम्।
शिवां स्यो॒नामनुं
चरेम विश्वा॥”
(অথর্ববেদ ১২।১।১৭)
এখানে পৃথিবীকে, অর্থাৎ বিশাল পৃথিবী বা সমগ্র জগতকে
ধর্ম দ্বারা ধারণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার সার্বিক সেবা করার
আদেশ দেওয়া হয়েছে। ‘धर्मणा धृता पृथिवी भूमिः’ এবং ‘धर्मो विश्वस्य जगतः प्रतिष्ठा’ উভয়ই সমার্থক। এই সূক্তের প্রথম মন্ত্রে যে পৃথিবীর ধারক
গুণের কথা বলা হয়েছে, তা সবই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
सत्यं बृहद्वृतमुग्रं दीक्षा तयो ब्रह्म यज्ञः पृथिवीं धारयन्ति॥
(অথর্ববেদ ১২।১।১)
সত্য, বিস্তৃত জ্ঞান, তেজস্বিতা, ব্রহ্মচর্যাদি দীক্ষা,
তপস্যা, ব্রহ্মজ্ঞান, যজ্ঞ, এই সমস্তই পৃথিবীকে ধারণ করে। ধারণ করার কারণে এগুলোই
ধর্ম।
ঋগ্বেদ ১০।৮৫।১ এ বলা হয়েছে—“सत्येनोत्तभिता भूमिः”
অর্থাৎ, সত্য পৃথিবীকে ধারণ করা রেখেছে। সেই সত্যই
সর্বোচ্চ ধর্ম, যেমন বলা হয়েছে—“नास्ति सत्यात् परो धर्मः”। এই সুপ্রসিদ্ধ শাস্ত্রবাক্যেও সত্যকে সবচেয়ে বড় ধর্ম
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়টির স্পষ্ট ব্যাখ্যা শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪।৪। ২। ২৬
এর নিম্নোক্ত উক্তিতে পাওয়া যায়—
“यो वै स धर्मः सत्यं वै तत् तस्मात् सत्यं वदन्तमाहुर्धर्मैव वदतीति। धर्मे वा वदन्तं सत्यं वदतीति॥”
(শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪।৪।২।২৬)
অর্থাৎ, ধর্ম এবং সত্য একই। তাই সত্যবাদীকে বলা হয় যে
সে ধর্মের কথা বলছে এবং ধর্ম বাণীর বক্তাকে বলা হয় যে সে সত্য বলছে।
তাই অথর্ববেদ ১২।১।৮ এ পৃথিবীর বিষয়ে বলা হয়েছে—
“यस्या हृदयं परमे व्योमन्त्सत्येनार्वृतममृत पृथिव्याः। सा नो भूमिस्त्विषं बलं राष्ट्रे दधतूत्तमे॥”
(অথর্ববেদ ১২।১।৮)
অর্থাৎ, যে পুথিবীর অমৃত হৃদয় সত্যের দ্বারা আবৃত, সেই
পৃথিবী আমাদের উত্তম জাতির মধ্যে শক্তি, দীপ্তি ও বলের প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। এখানে
সত্যকেও ধর্মের সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, যেমনটি শতপথ ব্রাহ্মণ এর
পূর্বোক্ত বাক্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কণাদ মুনি তাঁর “বৈশেষিক দর্শন ১।১।২” এ
ধর্মের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—
“यतो अभ्युदयनिःश्रेयससिद्धिः स धर्मः॥”
(वैशेषिक शास्त्र ১।১। ২)
যা দ্বারা অভ্যুদয় (এই সংসারের উন্নতি) এবং নিঃশ্রেয়স
(মোক্ষ) অর্জিত হয়, সেটাই ধর্ম। এই সংজ্ঞার মাধ্যমে, পৃথিবীতে যা কিছু উন্নতির
দিকে পরিচালিত করে এবং আত্মিক শান্তি, আনন্দ ও মোক্ষের প্রাপ্তি ঘটে, সবই ধর্মের
অন্তর্ভুক্ত। এটি ধর্মের একটি অত্যন্ত উচ্চতর, সার্বজনীন এবং সর্বব্যাপী সংজ্ঞা।
এই উচ্চতর সংজ্ঞার ভিত্তি বেদ মন্ত্র
আমাদের
বিশ্বাস এই যে, কণাদমুনি তাঁর বিশেষ দর্শনে ধর্মের যে লক্ষণ দিয়েছেন, তা তাঁর
কল্পনা থেকে নয়, বরং মূখ্যতঃ এর ভিত্তি বেদ মন্ত্রের নিম্নলিখিত
দুই মন্ত্রের উপর ভিত্তি করে বলেছেন—
" पावमानीर्दधन्तु न इम लोकमथो अमुम्।
कामान्त्समर्धयन्तु नो देवीदेवैः समाहृताः॥"
(সামবেদ ১৩০১)
" पावमानीः स्वस्त्ययनीस्ताभिर्गच्छति नान्दनम्।
पुण्याँश्च भक्षान् भक्षयत्यमृतत्वं त्वं च गच्छति॥"
(সামবেদ ১৩০৩)
এখানে "পবমান" অর্থাৎ, সকলকে পবিত্রকারী
ঈশ্বরের প্রদত্ত ঋচাগুলিকে "পবমানী" নামে ডাকা হয়েছে। (পবমানীঃ) পবমান
ঈশ্বরের প্রদত্ত এই ঋচাগুলি বা বাণী (নঃ) আমাদের (ইমে লোকম্) এই লোকের (অথো অমুম্)এবং
মোক্ষকে (দধন্তু) ধারণ করাক। (দেবীঃ) সমস্ত জ্ঞানকে উদ্ভাসিতকারী এবং এইভাবে
সুখদায়িনী (দেবী) দানাদ্বা দীপনাদ্বা দ্যোতনাদ্বা-নিরুক্তে। এই ঋচাগুলি (নঃ
কামান্ সমর্ধয়ন্ত) আমাদের কামনাগুলিকে পূর্ণ করুক।
(পবমানীঃ স্বস্ত্যয়নী) এই পবিত্রকারী, ঈশ্বর কর্তৃক
উপদেশপ্রাপ্ত ঋচাগুলি সুখের জ্ঞান প্রদানে, তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় এবং
তাকে লাভ করানোর জন্য সহায়ক হয়। (অয়-গতৌ গতেস্ত্রয়োঅর্থা জ্ঞানং গমনং প্রাপ্তিশ্চ
তাভিঃ নান্দনং গচ্ছতি) এর দ্বারা মানুষ সব ধরনের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি লাভ
করে। (টুনদিসমৃদ্ধৌ) (পুণ্যান্ চ ভক্ষান্ ভক্ষয়তি) এই জ্ঞান এবং সেই অনুযায়ী
আচরণের মাধ্যমে মানুষ পুণ্য ভোগগুলি উপভোগ করে এবং পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করে।
(অমৃতত্বং চ গচ্ছতি) এবং শরীরের নাশের পর অমৃতত্ব বা মোক্ষলাভ করে।
আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মন্ত্রগুলিতে
ব্যবহৃত "दधन्तु इमं लोकमयो अमुम्" এবং "पुण्याँश्च
भक्षान् भक्षयत्यमृतत्वं च गच्छति" দ্বারা যা বোঝানো হয়েছে, সেটিকেই শাস্ত্রকার কণাদমুনি
তাঁর "यतो अभ्युदयनिःश्रेयससिद्धिः स धर्मः" এই শব্দগুলিতে ব্যাখ্যা করেছেন, যার অর্থ একই।
মীমাংসা দর্শনকারের দ্বারা প্রদত্ত ধর্মের লক্ষণ
মীমাংসা শাস্ত্রকার জৈমিনি মুনি ধর্মের নিম্নলিখিত লক্ষণ
প্রদান করেছেন—
"चोदनालक्षणोऽर्थो धर्मः॥"
(মীমাংসা ১।২।৩)
অর্থাৎ, ধর্ম হলো সেই যা করার জন্য বেদের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা
রয়েছে। যদিও এই লক্ষণের সাথে অন্যান্য মতাবলম্বীরা একমত নাও হতে পারেন, তবে
আস্তিকেরা এই লক্ষণকে যথার্থ মনে করেন, যেমন এই গ্রন্থে আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি
এবং ভবিষ্যতেও প্রাসঙ্গিকভাবে করা হবে, বেদের শিক্ষাগুলি সর্বজনীন এবং সর্বকালের
জন্য প্রযোজ্য। এগুলি কোনও নির্দিষ্ট দেশ বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়। একইসঙ্গে বেদ
ঈশ্বরীয় জ্ঞান হওয়ার কারণে সকলের জন্য পথপ্রদর্শক এবং বেদের নির্দেশাবলী সর্বদা
নির্ভুল, পক্ষপাতমুক্ত এবং সবার জন্য উপকারী। এই বিষয়ে আমরা আরও আলোচনা করব।
মনু মহারাজ প্রদত্ত ধর্মের লক্ষণ—
মানব ধর্মশাস্ত্রের রচয়িতা মনু মহারাজ ধর্মের কয়েকটি
লক্ষণ বিভিন্ন স্থানে ব্যাখ্যা করেছেন। মনুস্মৃতির ২।১-এ বলা হয়েছে—
"विद्वद्भिः सेवितः सद्भिर्नित्यमद्वेषरागिभिः।
हृदयेनाभ्यनुज्ञातो यो धर्मस्तं निबोधत॥"
(মনুস্মৃতি ২।১)
অর্থাৎ, সর্বদা রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত বিদ্বান ও
সাধুগণের দ্বারা যে ধর্ম পালিত হয় এবং যা হৃদয়ের অনুমোদন পায়, তাকে ধর্ম মনে কর।
এটি একটি উচ্চতর এবং প্রশংসনীয় ধর্মের লক্ষণ।
মনুস্মৃতির অষ্টম অধ্যায়ে মনু মহারাজ ধর্মের ১০টি লক্ষণ
বর্ণনা করেছেন, এবং তিনি বলেছেন যে এই ধর্মের পালন সব আশ্রমের মানুষদের জন্য
অপরিহার্য।
"चतुर्भिरपि चैवैतैर्नित्यमा श्रमिभिर्द्विजैः।
दशलक्षणको
धर्मः सेवितव्यः प्रयत्नतः॥"
"धृतिः क्षमा दमोऽस्तेयं शौचमिन्द्रियनिग्रहः।
धीर्विद्या
सत्यमक्रोधो दशकं धर्म लक्षणम्॥"
(মনু ৬।৯১-৯২)
অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস
এই চারটি আশ্রমের সমস্ত মানুষের উচিত এই দশটি ধর্মের গুণাবলীকে মনোযোগ দিয়ে পালন
করা। ধর্মের এই ১০টি লক্ষণ নিম্নরূপ—
- ধৃতি— সর্বদা ধৈর্য ধারণ করা।
- ক্ষমা— সর্বদা ক্ষমাশীল থাকা।
- দম— মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অধর্মের পথে তাকে কখনও যেতে না দেওয়া।
- অস্তেয়— চুরি করা সম্পূর্ণ ত্যাগ, অর্থাৎ অন্যের জিনিস বিনা নির্দেশে বা ছল, কপটতা বা বিশ্বাসঘাতকতা বা কোন অন্যায় উপায়ে বা বেদ বিরুদ্ধ উপদেশে কোন পদার্থ গ্রহণ করাকে চুরি বলে।
- শৌচ— রাগ-দ্বেষ পক্ষপাত ছেড়ে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিকভাবে পবিত্র থাকা, যেমন নিয়মিত স্নান ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
- ইন্দ্রিয় নিগ্রহ— ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং তাদের সঠিক বা ধর্ম পথে পরিচালিত করা।
- ধী— মাদক দ্রব্য, বুদ্ধি নাশক জিনিস, খারাপ সঙ্গ এবং অলসতা, প্রমাদ (ভুল) ইত্যাদি এড়িয়ে, উৎকৃষ্ট পদার্থের গ্রহণ, সৎসঙ্গ, যোগাভ্যাসের মাধ্যমে বুদ্ধির বিকাশ করা উচিত।
- বিদ্যা— পৃথিবী থেকে শুরু করে পরমেশ্বর পর্যন্ত সবকিছুর যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা এবং সেই অনুযায়ী উপকার করা।
- সত্য— যে জিনিস যেমন আছে, তাকে তেমনভাবেই বোঝা, তেমনভাবেই বলা এবং তেমনভাবেই কাজ করা। অর্থাৎ, মন, বাক্য এবং কর্মে সত্যের প্রতি অনুগত থাকা।
- অক্রোধ— ক্রোধ না করা এবং শান্তি ইত্যাদি গুণ গ্রহণ করা।
এই দশটি গুণ ধর্মের লক্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই দশ
গুণবিশিষ্ট, পক্ষপাতশূন্য, ন্যায়াচরণ ধর্মের অনুশীলন চারটি আশ্রমের অধিকারী বা
সমস্ত পুরুষ ও নারীর জন্য প্রয়োজনীয়। এ ছাড়াও বেদে যজ্ঞের জন্য প্রথমে "ধর্ম"
শব্দটির ব্যবহার নিম্নলিখিত মন্ত্রে পাওয়া যায়—
"य॒ज्ञेन॑ य॒ज्ञम॑यजन्त दे॒वास्तान धर्माणि प्रथमान्या॑सन्।
ते हु नाकै महिमानः सचन्त॒ यत्र पूर्वे सा॒ध्याः सन्ति॑ दे॒वाः॥"
(যজুর্বেদ ৩১।১৬; অথর্ববেদ ৭।৫।১)
এই মন্ত্র, যা তার গুরুত্বের কারণে দুইবার ঋগ্বেদ এবং
একবার করে যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে এসেছে, বলেছে—(দবাঃ) সত্যনিষ্ঠ বিদ্বানগণ (যজ্ঞেন্)
যজ্ঞের দ্বারা (যজ্ঞম্) যজনীয় ও পূজ্য বিষ্ণু তথা সর্বব্যাপী পরমেশ্বরকে (যজ্ঞং বৈ
বিষ্ণুঃ । কৌষী ৪।১, ১৮।৮; তাণ্ড্য ৯।৬।১০; শত০ ১।১।২।১৩; গো০ উ০ ৪।৬; তৈত্তি০
১।২।৫।১) (অয়জন্ত) পূজা করেন (তানি প্রথমানি ধর্মাণি আসন্) ঐ যজ্ঞের অধীনে দেবপূজা,
সংগতিকরণ এবং দান— এই তিনটি প্রথম ও সর্বোচ্চ ধর্ম বলে গণ্য। (তে মহিনানঃ
নাকং হসচন্ত) যজ্ঞ পালনকারী মহাত্মারা
দুঃখহীন, পরমানন্দময় মোক্ষ লাভ করেন। (যত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তি) যেখানে পূর্ববর্তী সিদ্ধ ও সাধকগণ বিচরণ করেন।
এই মন্ত্রের প্রথম অংশে "যজ্ঞেন" শব্দটির একবচন এবং "তানি ধর্মাণি প্রথমানি" শব্দের বহুবচন একইসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। এই বহুবচন প্রয়োগ নিস্প্রয়োজন নয়। যজ্ঞ শব্দের মধ্যে দেবপূজা অর্থাৎ দেবাদিদেব পরমেশ্বর ও সত্যনিষ্ঠ বিদ্বানগণের পূজা, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা স্থাপন, মিলিতভাবে সমাজের কল্যাণ চিন্তা এবং যোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দানসেবা—এই তিনটি কর্তব্যের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। এই তিন ধারাবাহিক কর্তব্য পালন সহায়ক হওয়ার জন্য যজ্ঞকে শ্রেষ্ঠ কর্ম এবং তাকে দুঃখমুক্ত মোক্ষের পথ হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে।
