ও৩ম্
আধুনিক সমাজে খাদ্য সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব
আধুনিক সমাজে
খাদ্য
সংক্রান্ত একটি
বিশেষ
দ্বন্দ্ব আজও
রয়ে
গেছে,
যেখানে
প্রতিটি ব্যক্তির আলাদা
দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি
- ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা: ঈশ্বর গাছ-পালা, পশু ইত্যাদি সকল কিছু খাওয়ার জন্য সৃষ্টি করেছেন।
- নাস্তিকদের বিশ্বাস: ঈশ্বর, আত্মা ইত্যাদি কিছুই নেই। তাই শাক-সবজি খান বা মাংস, তাতে কোনো পাপ হয় না।
- অহিংসার সমর্থকরা: তারা আরও একটি মত পোষণ করেন যে শুধুমাত্র পশু নয়, গাছ-পালাতেও জীব আছে। তাই সেগুলিকে খাওয়াতেও হয় এবং গাছ কাটার মাধ্যমে আমরা মাংসাশী হয়ে যাচ্ছি, কারণ আমরা তাদের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাচ্ছি। এটাও একটি ধরনের জীবহত্যা।
ধর্মীয় শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ
ন্যায়সঙ্গতভাবে আমরা
ধর্মীয় শাস্ত্রগুলির উপর
যদি
বিবেচনা করি
তবে
আমরা
এই
সমস্যার সমাধান
বের
করতে
পারি।
জড় ও সচেতন জগত
বিশ্বে দুই
ধরনের
জগৎ
রয়েছে। জড়
এবং
সচেতন।
সচেতন
জগতের
দুটি
বিভাগ
রয়েছে। একটি
চর
এবং
একটি
অচর।
গাছপালা ইত্যাদি অচর
শ্রেণীতে পড়ে,
যখন
মানব
ও
পশু
ইত্যাদি চর
শ্রেণীতে পড়ে।
মহাভারতে গাছপালার প্রজাতি
মহাভারতের
মতে গাছপালা, ঔষধি, গুল্ম, গুচ্ছ, লতা, বেল, তৃণ
ইত্যাদির অনেক প্রজাতি আছে।
(সূত্র- ৫৮.২৩)
মনু স্মৃতির বিবরণ
- উদ্ভিজ্জ
স্থাবর
বীজ:
মনু স্মৃতিতে বীজ বা ডালের
মাধ্যমে উৎপন্ন হওয়াকে উদ্ভিজ্জ স্থাবর বীজ বলা হয়েছে।
(সূত্র- ১.৪৬)
- পাপাচরণের
ফল:
মনু স্মৃতির মতে, যখন একজন
মানুষ শরীর থেকে পাপাচরণ
করে, তখন তার ফলস্বরূপ
পরবর্তী জন্মে গাছপালা ইত্যাদির জন্ম হয়। (সূত্র-
১২.৯)
- তমোগুণী আচরণ: মনু স্মৃতির মতে, যে ব্যক্তি অত্যন্ত তমোগুণী আচরণ করে বা অত্যন্ত তমোগুণী প্রবৃত্তির অধিকারী হয়, তার ফলস্বরূপ পরবর্তী জন্মে স্থাবর (গাছ), পতঙ্গ, পোকা, মৎস্য, সাপ, কচ্ছপ, পশু এবং মৃগের জন্ম হয়। (সূত্র- ১২.৪২)
মনু রাজার ঘোষণার সারসংক্ষেপ
মনু
রাজা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে পূর্বজন্মের
অধম কর্মের কারণে গাছপালা ইত্যাদি স্থাবর জীব অত্যন্ত তমোগুণ
দ্বারা আচ্ছন্ন হয়। এই কারণে
এগুলি অন্তঃচেতনা থাকা সত্ত্বেও আভ্যন্তরীণভাবে
কর্মফলস্বরূপ সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা
করে। বাহ্যিক সুখের অভিজ্ঞতা এদের জন্য নগণ্য
বা একদম নেই।
আধুনিক বিজ্ঞান ও জীবের চেতনা
আধুনিক
বিজ্ঞান গাছপালায় জীব বিষয়ক মতামতের
সমর্থন ড. জগদীশ চন্দ্র
বসু চেতনতা হিসেবে করে, জীবাত্মা হিসেবে
নয়। দেখা যায় যে
উভয়ের মধ্যে মৌলিকভাবে কোনো পার্থক্য নেই
কারণ চেতনা জীবের একটি চিহ্ন। ভারতীয়
দর্শনের তত্ত্ব অনুসারে, যেখানে চেতনা আছে, সেখানে জীব
আছে এবং যেখানে জীব
আছে, সেখানে চেতনা আছে।
আধুনিক বিজ্ঞান ও গাছপালায় জীব
আধুনিক
বিজ্ঞান গাছপালায় জীবকে তাই মানে না
কারণ এটি শুধুমাত্র সেই
বিষয়কেই গ্রহণ করে যা গবেষণাগারে
প্রমাণিত হয়েছে এবং জীবাত্মাকে কখনোই
গবেষণাগারে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
ড. জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান
ড.
জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম বিজ্ঞানী
ছিলেন, যিনি এমন যন্ত্রের
আবিষ্কার করেছিলেন যার মাধ্যমে গাছপালা
এবং উদ্ভিদে বায়ু, নিদ্রা, খাদ্য, স্পর্শ ইত্যাদির জৈবিক প্রভাবের অধ্যয়ন করা যায়।
শাস্ত্রের ভিত্তিতে গাছপালায় আত্মার প্রমাণ
এছাড়াও
শাস্ত্রের ভিত্তিতে এটি প্রমাণিত হয়েছে
যে গাছপালাগুলিতে আত্মা রয়েছে। এখন শাস্ত্রের ভিত্তিতে
আমরা প্রমাণ করব যে গাছপালা
কাটা বা উদ্ভিদগুলিকে মূল
থেকে উপড়ে ফেলার ক্ষেত্রে হিংসা ঘটে না।
সংখ্যা দর্শন ৫/২৭-এর বিশ্লেষণ
সংখ্যা
দর্শনে ৫/২৭-এ
লেখা হয়েছে যে কষ্ট কেবল
সেই জীবকে পৌঁছায় যার সমস্ত অবয়বের
সাথে একটি সম্পর্ক বিদ্যমান
থাকে, অর্থাৎ সুখ-দুঃখের অনুভূতি
ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ঘটে।
যেমন
অন্ধকে যতই চড় মারুন,
বধিরকে যতই গালি দিন,
তাদের কষ্ট হয় না।
ঠিক একইভাবে গাছপালাগুলিও ইন্দ্রিয়হীন। অতএব, তাদের দুঃখের অনুভূতি হয় না।
একইভাবে
অজ্ঞান অবস্থায় দুঃখের অভিজ্ঞতা হয় না। সেই
কারণে গাছপালাগুলির আত্মা মূর্ছা অবস্থার কারণে ব্যথা বা কষ্ট অনুভব
করে না।
এবং
এই কারণে দুঃখের অনুভূতি না হওয়ায় গাছপালা
কাটা, ছাঁটা, খাওয়ার মধ্যে কোনো পাপ হয়
না এবং এতে জীবহত্যার
কোনো সম্পর্ক স্থাপন হয় না।
ঈশ্বরের নিদিষ্ট বিকল্প: শাকাহার
ভোজনের
জন্য ঈশ্বরের নিদিষ্ট বিকল্প শুধুমাত্র শাকাহার এবং এই ব্যবস্থা
কোনো পাপ সৃষ্টি করে
না, যেখানে মাংসাহার পাপের কারণ।
মনু ৫/৪৮-এর আলোকে
মনু
৫/৪৮ অনুযায়ী, প্রাণীদের
হত্যার মাধ্যমে মাংস পাওয়া যায়,
প্রাণী হত্যা ছাড়া মাংস পাওয়া সম্ভব
নয় এবং প্রাণী হত্যা
দুঃখ ভোগের কারণ, অতএব, মাংস খাওয়া উচিত
নয়।
বেদের উদ্ধৃতি
ঈশ্বরের
বাক্য বেদে প্রমাণিত হয়
যে—
মাংসং
ন অশনীয়াৎ।
অর্থ:
মাংস খাওয়া উচিত নয়।
মা
নো হিংসিষ্ট দ্বিপদো মা চতুষ্পদঃ। (অথর্ব ১১.২.১)
অর্থ:
দুই পায়ের (মানুষ, পাখি ইত্যাদি) এবং
চার পায়ের পশুদের হত্যা কোরো না।
ইমং
মা হিংসীর্দ্বিপাদ পশুম্। (যজু ১৩.৪৭)
অর্থ:
এই দুই খুরের পশুর
হত্যা কোরো না।
প্রমাণের গুরুত্ব
প্রমাণ সবথেকে
বেশি
শক্তিশালী হয়,
কারণ
এটি
আমাদের
বিশ্বাস ও
ধারণাকে ভিত্তি
এবং
যুক্তির সঙ্গে
যুক্ত
করে।
যখন
আমরা
কোন
ধারণা
বা
মতবাদ
গ্রহণ
করি,
তখন
তার
পেছনে
যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ
থাকা
অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষ
করে
খাদ্যাভ্যাসের মতো
বিষয়গুলোতে, প্রমাণ
আমাদের
সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় একটি
গঠনমূলক ভূমিকা
পালন
করে।
ধর্মীয় শাস্ত্র ও
বিজ্ঞান উভয়ের
মধ্যে
সমন্বয় করা
হলে,
আমরা
আমাদের
আচরণকে
আরও
কার্যকর ও
সঠিকভাবে গঠন
করতে
পারি।
যেমন,
যখন
শাস্ত্রে বলা
হয়
যে
"মাংস
খাওয়া
উচিত
নয়,"
তখন
তা
আমাদের
নৈতিক
দায়িত্বের উপর
একটি
সূক্ষ্ম আলো
ফেলে।
এর
মাধ্যমে আমরা
বুঝতে
পারি
যে,
শাস্ত্রের নির্দেশনা শুধুমাত্র একটি
আধ্যাত্মিক নির্দেশনা নয়,
বরং
এটি
মানবিক
অনুভূতি, জীবজগতের প্রতি
সম্মান
এবং
সঠিক
খাদ্যাভ্যাসের উপর
ভিত্তি
করে।
শাস্ত্রের নীতিগুলি আমাদের
জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে একটি
নৈতিক
এবং
ন্যায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান
করে।
এভাবে,
প্রমাণ
আমাদেরকে সচেতন
করে
তোলে
এবং
একটি
দায়িত্বশীল ও
সদর্থক
জীবনযাপনের পথে
পরিচালিত করে।
এছাড়াও, এই
প্রমাণগুলি আমাদের
জন্য
একটি
মানসিক
প্রশান্তির উৎস,
যা
আমাদের
বিশ্বাসকে আরও
শক্তিশালী করে
এবং
নৈতিক
দায়িত্বের প্রতি
আমাদের
সচেতনতা বাড়ায়।
এই কারণেই,
ধর্মীয় এবং
নৈতিক
শাস্ত্রের প্রমাণগুলি আমাদের
খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা ও
আচার-আচরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন
করে।
এর
মাধ্যমে আমরা
নিজেদের এবং
আমাদের
চারপাশের পরিবেশের প্রতি
দায়িত্বশীল হতে
পারি।
আর্যদের জন্য নির্দেশনা
আর্যদের উচিত
তাদের
জীবনকে
প্রমাণের সাথে
সঙ্গতিপূর্ণ করা,
অর্থাৎ
তাঁরা
যেভাবে
নিজেদের জীবনযাত্রা ও
আচরণ
নির্ধারণ করেন,
তা
যেন
তাদের
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং
ঐতিহ্য
অনুযায়ী হয়।
প্রমাণিত সত্য
ও
শাস্ত্রের নির্দেশনা মেনে
চলার
মাধ্যমে তাঁরা
নিজেদের নৈতিকতা ও
সংস্কৃতিকে উন্নত
করতে
পারেন।
এই নির্দেশনার মাধ্যমে আর্যদের আহ্বান
জানানো
হচ্ছে
যেন
তারা
ভক্ষণ
ও
আচরণের
ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেন।
মাংসাহার পরিবর্তে শাকাহার গ্রহণ
করা
এবং
প্রাণীদের প্রতি
সহানুভূতি প্রদর্শন করা,
তাঁদের
মানবিক
মূল্যবোধের প্রকাশ
হবে।
এছাড়াও, শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসরণ
করে
জীব
হত্যা
থেকে
বিরত
থাকা
একটি
মহৎ
কাজ
হিসেবে
বিবেচিত হবে।
এভাবে জীবনকে
শাস্ত্রের নির্দেশনার সাথে
সঙ্গতিপূর্ণ করার
মাধ্যমে আর্যরা
নিজেদের ধর্মীয় এবং
সামাজিক অবস্থানকে সুদৃঢ়
করতে
পারেন
এবং
মানবতা
ও
অহিংসার প্রতি
তাদের
প্রতিশ্রুতি বজায়
রাখতে
সক্ষম
হন।
এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন দ্বারা তাঁরা একটি মানবিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে।
