ধর্ম ও বিজ্ঞান: বেদ কি সত্যিই বিজ্ঞানসম্মত? এক তুলনামূলক বিশ্লেষণ

ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে এক গভীর বিশ্লেষণ। বেদ কি সত্যিই বিজ্ঞানসম্মত? বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সাথে তুলনামূলক আলোচনা।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক
বেদ এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
সূচীপত্র

ধর্ম ও বিজ্ঞান: বেদের আলোকে

এই অধ্যায়ে আমরা সংক্ষেপে দেখাবো যে, বেদ শুধুমাত্র ধর্মের মূল উৎস নয়, একইসঙ্গে সেটিই বিজ্ঞানেরও মূল। তাই বৈদিক ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে বিরোধের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

ধর্মের ব্যবহার: প্রাকৃতিক এবং নৈতিক অচল নিয়ম

বেদে ধর্ম শব্দের ব্যবহার বহু স্থানে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সভাপতিত্বে প্রাকৃতিক এবং নৈতিক জগতে কার্যকরী অচল নিয়মের জন্য করা হয়েছে। যেমন ঋগ্বেদ ৬।৭০।১-এ বলা হয়েছে-

দ্যাভাপৃথিবী বরুণস্য ধর্মণা বিষ্কভিতে অজরে ভুরিরেতসা।
(ঋগ্বেদ ৬।৭০।১)

অর্থাৎ, অত্যন্ত শক্তি এবং তেজে পরিপূর্ণ দ্যুলোক ও পৃথিবী লোক (বরুণস্য ধর্মণা বিষ্কভিতে) বরণযোগ্য এবং সর্বোত্তম ঈশ্বরের ধর্ম-ধারক শক্তি এবং তাঁর অচল সর্বধারক নিয়মের দ্বারা ধারণ করা হয়েছে।

এ ধরনের অচল নিয়মের নির্মাতা সর্বজ্ঞ ঈশ্বর। তাই বেদে তাঁকে "ধর্মকৃৎ" এই নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদ ৮।৯৮।১-এ এইরকম দেখা যায়-

ইন্দ্রায়ায় সাম গায়ত বিমায়া বৃহতে বৃহৎ।
ধর্মকৃতে বিপশ্চিতে পনস্যবে।।
(ঋগ্বেদ ৮।৯৮।১)

অর্থাৎ, (বৃহতে) মহান, (বিপ্রায়) শান্তি ও আনন্দের সঙ্গে সকলকে বিশেষভাবে পূর্ণকারী, (ধর্মকৃতে) প্রাকৃতিক এবং নৈতিক নিয়মের ধারক এবং নির্মাতা, (বিপশ্চিতে) সর্বজ্ঞ, (পনস্যবে) প্রশংসাযোগ্য, (ইন্দ্রায়) ঐশ্বর্যযুক্ত প্রভুর জন্য (বৃহৎ সাম গায়ত) বৃহৎ সামের গীত করো।

যেহেতু প্রাকৃতিক এবং নৈতিক জগতে কার্যকরী অচল নিয়মের উপস্থাপনা ব্রহ্মবেদে পাওয়া যায় এবং সেই বেদ জ্ঞানের দাতা হলেন করুণাময় ঈশ্বর, তাই সামবেদ ৩৮৮ এবং ১০২৫-এ "ব্রহ্মকৃতে" শব্দটি "ধর্মকৃতে" শব্দের স্থানে এসেছে। এর দ্বারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি প্রকাশ পায় যে, যিনি ঈশ্বর অচল নিয়মের নির্মাতা, তিনিই বেদের কৃর্তা, সুতরাং সেখানে কোনো বিরোধ থাকা সম্ভব নয়।

ধর্ম ও বিজ্ঞানের পূর্ণ সামঞ্জস্য এবং সমন্বয়

ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই পূর্ণ সামঞ্জস্য এবং সমন্বয় বৈদিক ধর্মের একটি বিশাল বৈশিষ্ট্য, যা অনেক নিরপেক্ষ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের দ্বারা উন্মুক্তভাবে স্বীকৃত হয়েছে। তাদের কিছু বক্তব্য আমরা তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা উপযুক্ত মনে করি।

মি. ব্রাউন-এর মন্তব্য

"Vedic Religion is a thoroughly Scientific Religion where religion and Science meet hand in hand. Here theology is based upon Science and Philosophy. It (Vedic Religion) recognises but one God." - W.D. Brown, "Superiority of Vedic Religion"

অর্থাৎ, বৈদিক ধর্ম একটি সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক ধর্ম যেখানে ধর্ম ও বিজ্ঞান হাতে হাত মিলিয়ে চলে। এখানে ধর্মীয় মতবাদ বিজ্ঞান এবং দর্শনের উপর নির্ভরশীল। এই ধর্ম শুধুমাত্র এক ঈশ্বরের উপাসনা মেনে চলে এবং তা শিক্ষা দেয়।

জ্যাকোলিয়ট্-এর বক্তব্য

"The Hindu Revelation (Veda) is of all Revelations the only one whose ideas are in perfect harmony with modern Science, as it proclaims the slow and gradual formation of the world." - Jacolliot, "The Bible in India", Vol. II. Chap. I

অর্থাৎ, "হিন্দুদের ঐশ্বরিক জ্ঞান 'বেদ' হল একমাত্র এমন ঐশ্বরিক জ্ঞান, যার ধারণাগুলি আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ এটি বিশ্বের ধীর এবং ক্রমিক গঠনকে প্রচার করে।"

আমেরিকান মহিলার উক্তি

"We have all heard and read about the ancient religion of India. It is the land of the great Vedas-the most remarkable works containing not only religious ideas for a perfect life, but also facts which all science have since proved to be true. Electricity, radium, electrons, airships, all seems to be known to the seers who found the Vedas". - Mrs. Wheeler Wilcox, "Mother America"

অর্থাৎ, "আমরা সবাই প্রাচীন ভারতের ধর্ম সম্পর্কে শুনেছি এবং পড়েছি। এটি মহান বেদের ভূমি, যা অত্যন্ত বিস্ময়কর, কারণ এতে কেবলমাত্র পূর্ণ জীবনের জন্য ধর্মীয় ধারণাগুলিই উল্লেখ করা হয়নি, বরং সেই সমস্ত সত্যেরও বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলি আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে। বিদ্যুৎ, রেডিয়াম, ইলেকট্রন, বিমান এবং উড়োজাহাজ ইত্যাদি সবকিছুই বেদ আবিষ্কারকারী ঋষিদের কাছে পরিচিত বলে মনে হয়।"

অধ্যাপক ম্যাক্স মুলারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি

জার্মান পণ্ডিত অধ্যাপক ম্যাক্স মুলার স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর বিষয়ে লিখেছেন:

"To Swami Dayananda, everything contained in the Vedas was not only perfect truth, but he went one step further and by their interpretation succeeded in persuading others that everything worth knowing, even the most recent inventions of modern science, were alluded to in the Vedas-steam engine, electricity, telegraphy and wireless microgram were shown to have been known at least in the germs to the poets of the Vedas". - Prof. Max Muller, "Biographical Essays"

অর্থাৎ, "স্বামী দয়ানন্দের কাছে বেদে উল্লিখিত প্রতিটি বিষয়ই কেবলমাত্র পরিপূর্ণ সত্য ছিল না, বরং তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তার ভাষ্যের মাধ্যমে অন্যদের এই বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে প্রতিটি জিনিস, যা জানার যোগ্য, এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারগুলি, যেমন- স্টিম ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ, টেলিগ্রাফি এবং বেতার ইত্যাদি, অন্তত বীজ আকারে হলেও, বৈদিক ঋষিদের কাছে পরিচিত ছিল।"

যদিও এই বক্তব্যে অধ্যাপক ম্যাক্স মুলার তাঁর নিজস্ব কোনো মতামত প্রকাশ করেননি, তবে তাঁর আরেকটি বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি স্বামী দয়ানন্দের এই মতবাদ দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন:

"The distinguishing feature of Hinduism, however, is that it is a thoroughly scientific religion, religion and science went hand in hand in ancient India. The Religious tenets of other nations have been proved and are admitted by men of culture and thought, to be in conflict with the teaching of Modern Science. In India, however, theology is founded upon philosophy and science." - Prof. Max Muller, quoted in "The India of Old"

অর্থাৎ, "হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য হল এটি একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বৈজ্ঞানিক ধর্ম। প্রাচীন ভারতে ধর্ম ও বিজ্ঞান হাতে হাত মিলিয়ে চলত। অন্যান্য জাতির ধর্মীয় মতবাদগুলি আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষার বিরোধী প্রমাণিত হয়েছে এবং সুশৃঙ্খল চিন্তাশীল ব্যক্তিরা তা স্বীকারও করেছেন। তবে ভারতে ধর্ম তত্ত্ববিদ্যা (theology) দর্শন এবং বিজ্ঞান (science)-এর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।"

খ্রিস্টধর্মের অনেক বিষয় বিজ্ঞানবিরোধী

শ্রী জ্যাকোলিয়ট্ এবং অধ্যাপক ম্যাক্স মুলার বিভিন্ন ধর্মমতগুলির সৃষ্টির উৎপত্তি সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে বিজ্ঞান থেকে যে বিরোধ প্রদর্শন করেছেন, তার কিছু উদাহরণ দিয়ে এই প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বাইবেলের Genesis (উৎপত্তি বই) নামক গ্রন্থে সৃষ্টির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা বিজ্ঞান ও দর্শনের বিপরীত। Genesis-এর প্রথম অধ্যায় অনুযায়ী, ঈশ্বর বলেছেন:

"God said, let there be light and there was light" - Genesis 1:3

এই বিষয়টি মনে রাখা উচিত যে বাইবেলের মতে প্রথম দিনেই আলো সৃষ্টি হয়েছিল, যখন সূর্য-চন্দ্রের সৃষ্টি চতুর্থ দিনে হয়েছিল। এটি কতটা অসঙ্গত তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই বিষয়টি প্রসিদ্ধ দার্শনিক তলস্তয় তার "What is Religion" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:

"Not to speak of all the absurdities of the old Testament such as the creation of the light before the sun, the creation of the world six thousand years ago........" - Leo Tolstoy, "What is Religion"

এছাড়া, বাইবেলের মতে ঈশ্বর ৬ দিনে সৃষ্টিকে তৈরি করেছেন এবং সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নেন। সৃষ্টিকে প্রায় ৬০০০ বছর পূর্বে গণ্য করাও বিজ্ঞানের বিরোধী।

বৈদিক সৃষ্টিতত্ত্ব: শূন্য থেকে নয়, প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি

বৈদিক ধর্ম অনুযায়ী, সৃষ্টি শূন্য থেকে হয় না, বরং এর উপাদান কারণ (Material Cause) হল চিরন্তন প্রকৃতি। একে বেদে সৎ, আপঃ, অদিতি, স্বধা, সলিলম্, অজা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে বলা হয়েছে। ঋগ্বেদ-এর দশম মণ্ডলের ৭২তম এবং ১২৯তম সূক্তে সৃষ্টির উৎপত্তির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

ঋগ্বেদ অনুসারে সৃষ্টির ক্রমবিকাশ

ব্রহ্মণস্পতিতাঃ সং ক্র ইবাদমত্।
দেবানাম পূর্ব্যৈ যুগে’সতঃ সদজায়ত॥
(ঋগ্বেদ ১০।৭২।২)

অর্থাৎ, দেবতাদের আদির সৃষ্টি কালে ব্রহ্মাণ্ড এবং বেদের প্রভু পরমাত্মা এই সব পদার্থকে যেমন কোনো শিল্পী বস্তু তৈরি করেন, তেমনভাবেই সৃষ্টি করেছিলেন। সেই সময় সমগ্র জগত অব্যক্ত অবস্থা (অসৎ) থেকে ব্যক্ত অবস্থায় (সৎ) আসতে শুরু করে।

ভূর্জজ্ঞ উত্তানপদো ধ্রুব আশাঃ আজায়ন্ত ।
অদিতের্দক্ষণো অজায়ত দক্ষসাদ্বদিতিঃ পরি ॥
(ঋগ্বেদ ১০।৭২।৪)

অর্থাৎ, পৃথিবী উদ্ভিদদের প্রকাশ করে। পৃথিবী থেকে দিকসমূহ সর্বদিকেই পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হতে শুরু করে। এইভাবে অচেতন প্রকৃতি (অদিতি) থেকে চেতন জীবধারী প্রাণীরা (দক্ষ) এবং চেতন থেকে অচেতন প্রকৃতি প্রকাশিত হয়।

অথর্ববেদে প্রকৃতির উপাদান কারণতত্ত্ব

অথর্ববেদ ১০।৮।৩০-এ প্রকৃতির স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে:

"এষা সনত্নী সনমেব জাতৈষা ইউরাণী পর সর্ভং বভূব।
মহী দেবিউষ বিভাতী সৈকেনৈকেন মিষতা ভি চষ্টে॥"

অর্থাৎ, এটি সনাতন, নিত্য প্রকৃতি, যা পুরানো হওয়া সত্ত্বেও সর্বদা নতুন রূপ ধারণ করে। এই প্রকৃতি সমস্ত কার্যের মধ্যে পূর্ণভাবে বিরাজমান।

প্রকৃতির নিত্যতা: বেদ ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন

বিজ্ঞানের "Indestructibility of Matter" (পদার্থের অবিনাশিতা) তত্ত্বের সঙ্গে বেদে প্রকৃতির নিত্যতা তত্ত্ব সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রকৃতির এই নিয়মগুলি আবিষ্কার করাই হলো ভৌত বিজ্ঞানের লক্ষ্য। এই কথাগুলি পড়তে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে যায় বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সেই উক্তি:

"I believe in God who reveals himself in the orderly harmony of the universe... The basis of all Scientific work is the conviction that the world is an ordered and comprehensive entity and not a thing of chance." - Albert Einstein

আমরা পরে দেখাবো যে খ্রিস্টধর্মের মতো অনেক ধর্মে প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ অনেক কথা আছে, যেমন অলৌকিক ঘটনা (Miracles)-এর ধারণা, যা বিজ্ঞান কখনো মেনে নিতে পারে না।

বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞান: পৃথিবী গোল এবং গমনশীল

বেদে পৃথিবীকে গোলাকার এবং সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি মন্ত্রের উল্লেখ করা হলো, যেমন ঋগ্বেদ ১০।১৮৯।১-এ বলা হয়েছে:

"আয়ং গৌঃ পৃশ্নিরক্রমাদসদন্মাতর পুরঃ।
পিতর চ প্রয়ন্ত্স্বঃ॥"

অর্থাৎ, এই পৃথিবী (গরুর প্রতীকী রূপে) গোলাকার এবং তার গমনশীলতাকে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি প্রত্যক্ষ গোলাকার পৃথিবী (পিতরং) পালনকারী (স্বঃ) সূর্যলোকের (পুরঃ) সামনে চলে এবং নিজ মাতৃ-রূপ জলগুলোর সঙ্গে সঠিকভাবে চলতে থাকে এবং আকাশে চারদিকে ঘুরতে থাকে।

"গৌঃ" শব্দের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

এই মন্ত্রে "গৌ" শব্দটি এসেছে, যা নিঘণ্টু অনুযায়ী পৃথিবীর নাম। যাস্কাচার্য নিঘণ্টুতে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, "গচ্ছতীতিগৌঃ" অর্থাৎ গতিশীল। এই মন্ত্র থেকে পৃথিবীর গোলাকার হওয়া এবং সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণন করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সব বর্তমান বিজ্ঞানীদের দ্বারা মান্য, যদিও খ্রিস্ট ধর্মের গ্রন্থ বাইবেল এর স্পষ্ট বিরোধিতা করে।

আর্যসিদ্ধান্তের প্রমাণ

এই একই তথ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থ আর্য সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়েছে:

ভপংজরস্থিরো ভূরেবা বৃত্যা বৃত্য প্রতিদৈবাসিকৌ।
উদয়াস্তময়ৌ সম্পাদয়তি গ্রহ নক্ষত্রাণাম্॥
(আর্য সিদ্ধান্ত)

অর্থাৎ, সূর্য ইত্যাদি নক্ষত্র স্থির, পৃথিবী প্রতিদিন তার অক্ষের চারপাশে ঘুরে এদের উদয় এবং অস্তকে সম্পন্ন করে।

বিজ্ঞানের উপর অত্যাচার এবং বাইবেলের ভূমিকা

খ্রিস্টধর্মের ঈশ্বরীয় জ্ঞান হিসেবে গৃহীত গ্রন্থ বাইবেলে পৃথিবীকে স্থির ও চ্যাপ্টা এবং সূর্যকে তার চারপাশে ঘুরতে বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাইবেলের যোশুয়া (Joshua) অধ্যায় ১০ এর ১৩ নম্বর অংশে লেখা হয়েছে:

"And the sun stood still and the moon stayed, until people had avenged themselves upon their enemies." - Joshua 10:13

অর্থাৎ, "তখন সূর্য স্থগিত হল, ও চন্দ্র স্থির থাকল, যতক্ষণ না সেই জাতি শত্রুদের প্রতিশোধ নিল।"

বাইবেলের এই পৃথিবীর স্থিরতা এবং সূর্যের গতির সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে খ্রিস্টান গুরুরা গ্যালিলিও, ব্রুনো প্রমুখ বৈজ্ঞানিকদের ওপর যে অত্যাচার করেছেন, তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

গ্যালিলিও এবং ব্রুনোর উপর অত্যাচার

গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২ খ্রি.) এই তথ্য প্রচার করার কারণে যে পৃথিবী গোল এবং এটি সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তাকে পোপের সভাপতিত্বে ইনকুইজিশন কোর্ট ১০ বছরের কঠোর কারাবাসের শাস্তি দেয় এবং জেলে তার মৃত্যু হয়।

ব্রুনো নামক আরেক বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে এ ধরনের নিষ্ঠুর কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তাকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে জীবন্ত অবস্থায় তেল ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয়, যার উপর সেই সাহসী বিজ্ঞানী হাসতে হাসতে বলেছিলেন:

"It is with greater fear that you pass sentence upon me rather than I receive it." - Giordano Bruno

অর্থাৎ, আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে আপনারা আমার তুলনায় বেশি ভয় পাচ্ছেন, কারণ আপনি একজন নিরপরাধকে এই ধরনের কঠোর শাস্তি দিচ্ছেন।

ইনকুইজিশন কোর্টের নিষ্ঠুরতা

লৌরেন্টে নামক ঐতিহাসিক ইনকুইজিশন কোর্টের ১৮ বছরের ইতিহাস লিখে বলেছেন যে টরকেমেদা এবং তার সহযোগীরা ১৮ বছরে ১০,২২০ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে এবং ৯৭,৪২১ জনকে অন্যান্য শাস্তি দিয়েছে, কারণ তারা যুক্তি বা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে খ্রিস্টান ধর্মের অনেক বিষয়ে সন্দেহ করেছিলেন।

আধুনিক খ্রিষ্টীয় চিন্তাবিদদের স্বীকারোক্তি

খ্রিস্টান ধর্মের বিজ্ঞানবিরোধী মূল বিষয়গুলো নিয়ে বর্মিঙ্গহামের বিশপ ড. বার্নস একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি বিজ্ঞানের কাছে ধর্মের পরাজয়ের কথা স্বীকার করেন। তিনি চারটি প্রধান বিষয় তুলে ধরেন:

  1. পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র নয়।
  2. মানুষকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করা হয়নি।
  3. কোনও পুরোহিত আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অজীব পদার্থে আধ্যাত্মিক গুণ প্রদান করতে পারেন না।
  4. প্রকৃতির নিয়মের বড় ধরনের লঙ্ঘন বা অলৌকিক ঘটনা ঘটে না।

তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণার এই চারটি সুস্পষ্ট ফলাফল রয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

অলৌকিক ঘটনা এবং বিজ্ঞানের সংঘাত

এই সমস্তের আলোকে খ্রিষ্টীয় মতের বহু মতামত এবং বাইবেলে বর্ণিত চমৎকারগুলির (Miracles) ত্যাগ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে যিশু খ্রিষ্টের কুমারী মেরি থেকে উৎপত্তি, অন্ধদের চোখ দেওয়া, মৃতদের জীবিত করা, সমুদ্রের ওপর হাঁটা, ঝড়-তুফানকে শান্ত করা ইত্যাদি।

ড. ম্যান্সেল চমৎকার ঘটনাগুলির বিষয়ে লিখেছেন:

"If Miracles are denied, all Christianity, so far as it has any title to that name, so far as it has any special relation to Christ, is overthrown." - Dr. Mansel, "Aids to Faith"

অর্থাৎ, যদি চমত্কারগুলির অস্বীকৃতি জানানো হয়, তাহলে সমস্ত খ্রিষ্টধর্ম, যতটা তা যিশু খ্রিষ্টের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কিত, শেষ হয়ে যায়।

ঠিক এভাবেই প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে এবং অতএব বিজ্ঞানবিরোধী চমত্কারগুলির বর্ণনা ইঞ্জিল, কুরআন এবং অন্যান্য মত-ভিন্নতার গ্রন্থগুলিতে রয়েছে, যেগুলির সঙ্গে বিজ্ঞানের যুক্তি সমন্বয় অসম্ভব। কিন্তু বৈদিক ধর্মে এমন কোনো অবৈজ্ঞানিক বা যুক্তিহীন বিষয়ের স্থান নেই, যা এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।

About the author

অমৃতের পুত্র
The true seeker of Sanatan Dharma does not chase the divine in temples alone, but finds God in truth, in duty, and in the silence of the soul.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন