মাথায় শিখা বা চূড়া কেন রাখা হয়? জানুন এর অবাক করা ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক কারণ

মাথায় শিখা বা চূড়া রাখার কারণ কী? জানুন এর পেছনের অবাক করা বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় রহস্য এবং সুষুম্না নাড়ির উপর এর অবিশ্বাস্য প্রভাব।
শিখা বা চূড়া রাখার ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব
শিখা ধারণ বৈদিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যার ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে।

শিখা (চূড়া) কেন রাখা উচিত? ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব

সূচীপত্র (দেখতে ক্লিক করুন)

ভূমিকা: শিখার তাৎপর্য

বৈদিক ধর্মে মাথায় শিখা (চূড়া) ধারণ করার অসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। প্রত্যেক শিশুর জন্মের পর মুণ্ডন সংস্কারের সময় নবজাতকের মাথার সেই অংশে গরুর খুরের আকারের সমান একটি চূড়া রাখার বিধান রয়েছে। এটি মাথার ঠিক সেই স্থান, যেখানে সুষুম্না নাড়ি পিঠের মধ্যভাগ দিয়ে উপরের দিকে এসে শেষ হয় এবং সেখান থেকে মাথার বিভিন্ন অঙ্গের বায়ু প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য অসংখ্য সূক্ষ্ম বায়ু নাড়ি শুরু হয়। সুষুম্না নাড়ি পুরো শরীরের বায়ু প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য কথায়, এটি থেকেই বায়ু প্রতিষ্ঠান শুরু হয় এবং পরিচালিত হয়। যদি এটি থেকে নির্গত কোনো নাড়ি কোনো কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, তবে সেই অঙ্গে পক্ষাঘাত (অর্ধাঙ্গ) হয়। মনে রাখবেন, শরীরে যে শক্তি সঞ্চারিত হয়, তা সুষুম্না নাড়ির মাধ্যমেই হয়।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ: সুষুম্না নাড়ি ও মস্তিষ্ক

মাথার যে অংশে শিখা রাখা হয়, সেই স্থানে হাড়ের নিচে লঘুমস্তিষ্ক (Cerebellum) অবস্থিত, যা গরুর নবজাত বাছুরের খুরের আকারের মতো। শিখাও ঠিক ততটুকু বড় করে তার উপর রাখা হয়। চুল তাপ উৎপন্ন করে। চুলে বিদ্যুৎ সঞ্চিত থাকে, যা সুষুম্না নাড়িকে সর্বদা ততটুকু তাপ সরবরাহ করে, যা শরীরের সমস্ত বায়ু নাড়ি প্রতিষ্ঠানকে জাগ্রত ও উদ্দীপিত রাখতে প্রয়োজন। ফলে মানুষের বায়ু নাড়ি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুযায়ী জাগ্রত থাকে, যা পুরো শরীরকে শক্তি যোগায়। কোনো অঙ্গে পক্ষাঘাতের ভয় থাকে না। এছাড়া, লঘুমস্তিষ্ক বিকশিত হতে থাকে, যেখানে জন্ম-জন্মান্তরের এবং বর্তমান জন্মের সংস্কার সঞ্চিত থাকে।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ ভারতের যে ব্রাহ্মণরা বড় গুচ্ছাকার শিখা ধারণ করেন, তাঁদের মস্তিষ্ক শিখাবিহীন ব্রাহ্মণদের তুলনায় বিশেষভাবে বিকশিত। এই পরীক্ষা দক্ষিণ ভারতে অনেক বিজ্ঞানী করেছেন। সুষুম্নার যে অংশ লঘুমস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে, তা শিখা থেকে প্রাপ্ত তাপ (বিদ্যুৎ) দিয়ে চৈতন্য হয়। এর ফলে স্মৃতিশক্তিও বিকশিত হয়।

শাস্ত্রীয় প্রমাণ: বেদে শিখার বিধান

বেদে শিখা ধারণের বিধান বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ:

শিখিভ্যঃ স্বাহা॥
অর্থ: চূড়া ধারণকারীদের কল্যাণ হোক। (অথর্ববেদ ১৯-২২-১৫)
আত্মন্নুপস্থে ন বৃকস্য লোম মুখে শ্মশ্রূণি ন ব্যাঘ্রলোমা কেশা ন শীর্ষন্যশসে শ্রিয়ৈশিখা সিঁহস্য লোমত্বিষিরিন্দ্রিয়াণি ॥
অর্থ: যশ ও লক্ষ্মী প্রাপ্তির জন্য মাথায় শিখা ধারণ করুন। (যজুর্বেদ অধ্যায় ১৯, মন্ত্র ৯২)
যাজ্ঞিকৈগোদর্পণ মাজনি গোক্ষুর্বচ্চ শিখা।
অর্থ: যজ্ঞাধিকার প্রাপ্ত মানুষের মাথায় গরুর খুরের সমান স্থানে শিখা রাখা উচিত। (যজুর্বেদীয় কাঠকশাখা)
নোট: গরুর খুরের আকার বলতে গরুর বাছুর জন্মের সময় তার খুরের সমান আকারে শিখা ধারণ করা।
কেশানাঁ শেষ কারণং শিখাস্থাপনং কেশ শেষ করণম্। ইতি মঙ্গল হেতোঃ ॥
অর্থ: মুণ্ডন সংস্কারের পর যখনই মাথার চুল কাটা হবে, শিখার চুল ছেড়ে বাকি চুল কাটতে হবে। এটি মঙ্গলকর। (পারস্কর গৃহ্যসূত্র)
সদোপবীতিনা ভাব্যং সদা বদ্ধশিখেন চ। বিশিখো ব্যুপবীতশ্চ যৎ করোতি ন তৎকৃতম্ ॥
অর্থ: সর্বদা যজ্ঞোপবীত ও গিঁট দেওয়া শিখা ধারণ করতে হবে। শিখা ও যজ্ঞোপবীত ছাড়া যজ্ঞ, সন্ধ্যোপাসনা ইত্যাদি করলে তা করা ও না করা সমান। (কাত্যায়ন স্মৃতি ৪)

পাশ্চাত্য বিদ্বান ও বিজ্ঞানীদের চোখে শিখা

অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীও শিখার গুরুত্ব স্বীকার করেছেন:

ধ্যানের সময় ওজশক্তি প্রকট হয়। কোনো বিষয়ে চিন্তাশক্তি একাগ্র করলে ওজশক্তি সেদিকে ধাবিত হয়। ঈশ্বরের উপর ধ্যান একাগ্র করলে মাথায় শিখার পথে ওজশক্তি প্রকট হয় বা প্রবেশ করে। পরমাত্মার শক্তি এই পথেই মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে। সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন যোগীরা এই শক্তির অসাধারণ রঙও দেখতে পান। পরমাত্মার থেকে আগত শক্তি বর্ণনাতীত। - ড. ভিক্টর ই. ক্রোমার, "ভিরলি কল্পক"
The concentration of mind upwards sends a rush of this power through the top of the head.
অর্থ: শিখার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক সহজে এই ওজশক্তি ধারণ করে। - প্রফেসর ম্যাক্সমুলার
ভারতে বহু বছর ধরে ভারতীয় সভ্যতা ও ঐতিহ্য অধ্যয়ন করেছি। দক্ষিণ ভারতে মাথার অর্ধেক পর্যন্ত চুল রাখার প্রথা রয়েছে। তাঁদের মানসিক শক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, মাথায় শিখা মনের সংস্কৃতির জন্য খুব উপকারী। আমি এখন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী এবং শিখা ধারণের পক্ষে। - শ্রী হপসন, গার্ড পাখির নং ২৫৮
শিখার শরীরের অঙ্গগুলোর সঙ্গে প্রধান সম্পর্ক। এটি শরীরের বৃদ্ধি ও সমস্ত অঙ্গের পরিচালনায় সহায়ক। এই বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কারের পর আমি নিজে শিখা রাখতে শুরু করেছি। - বিজ্ঞানী সারলুকাস
আমার বিশ্বাস, হিন্দুদের প্রতিটি নিয়ম বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ। শিখা রাখা শুধু ধর্মীয় প্রতীক নয়, সুষুম্না নাড়ির রক্ষার জন্য ঋষিদের আবিষ্কৃত এক অপূর্ব চমৎকার। - ডা. ক্লার্ক
Hindus keep safety of Medulla oblongata by lock of hair. It is superior than other religious experiments. Any way, the safety of oblongata is essential.
অর্থ: হিন্দুরা শিখা রেখে সুষুম্নার রক্ষা করে। অন্য ধর্মের অনেক পরীক্ষার তুলনায় শিখা উৎকৃষ্ট। যে কোনো উপায়ে সুষুম্নার রক্ষা অপরিহার্য। - আর্ল টমাস, Alarm Magazine (১৮৮১)

শিখার কার্যকারিতা ও ব্যবহারিক উপকারিতা

মাথার যে স্থানে শিখা থাকে, তাকে Pinial Joint বলে। এর নিচে একটি গ্রন্থি থাকে, যাকে Pituitary বলে। এটি থেকে একটি রস নিঃসৃত হয়, যা শরীর ও বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণ, স্বাস্থ্যবান ও দীর্ঘজীবী করে। এর কার্যক্ষমতা শিখার বড় চুল ও সূর্যের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল।

মূলাধার থেকে মেরুমণ্ডল পর্যন্ত ব্যাপ্ত সুষুম্না নাড়ির একটি মুখ ব্রহ্মরন্ধ্রে (বুদ্ধি কেন্দ্রে) খোলে। এখান থেকে তেজ (বিদ্যুৎ) নির্গত হয়। শিখা বন্ধনের মাধ্যমে এটি রুদ্ধ থাকে। এই কারণে শাস্ত্রকাররা শিখায় গিঁট বেঁধে রাখার বিধান দিয়েছেন।

গুচ্ছাকার শিখা বাইরের তাপ ভিতরে প্রবেশে বাধা দেয় এবং সুষুম্না, লঘুমস্তিষ্ক ও সম্পূর্ণ স্নায়বিক প্রতিষ্ঠানকে তাপ থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের অতিরিক্ত তাপ বাইরে নির্গত করে। তবে, অত্যন্ত উষ্ণ অঞ্চলে শিখা না রাখলেও ক্ষতি হয় না। সন্ন্যাসীদের (চতুর্থ আশ্রমীদের) শিখা না রাখার নির্দেশ এই কারণে, যে তাঁরা তিন আশ্রমে শিখা রেখে শরীরকে পুষ্ট করেছেন। চতুর্থ আশ্রমে তাঁরা যোগাভ্যাসের মাধ্যমে বায়ু নাড়ি প্রতিষ্ঠানকে পুষ্ট করেন, তাই তাঁদের জন্য শিখা আর প্রয়োজন হয় না।

জাপানি কুস্তিগিররা মাথায় মোটা গিঁটযুক্ত শিখা ধারণ করে। এই ভারতীয় পরম্পরা আজও জাপানে দেখা যায়। শিখের চুল বায়ুমণ্ডল থেকে প্রাণশক্তি (অক্সিজেন) আকর্ষণ করে এবং স্নায়বিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শরীরে পৌঁছায়। এতে ব্রহ্মচর্যের সংযমে সহায়তা মেলে। শিখাবিহীন ব্যক্তিরা প্রায়শই কামুক ও উচ্ছৃঙ্খল হয়। শিখা মস্তিষ্ককে শান্ত রাখে এবং প্রভু চিন্তনে সাধকের সহায়ক হয়।

সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও আধুনিক অবহেলা

গুচ্ছাকার শিখা ও গিঁট বাঁধার কারণে প্রাচীন আর্যদের মধ্যে ব্রহ্মচর্য, তেজ, মেধা, বুদ্ধি, দীর্ঘায়ু ও বলের বিলক্ষণতা ছিল। ইংরেজি কুশিক্ষার প্রভাবে শিখা ও যজ্ঞোপবীত ত্যাগের ফলে এই গুণগুলি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। পাগলপন, অন্ধত্ব, মস্তিষ্কের রোগ আগে শিখাধারীদের হত না, এখন শিখাবিহীনদের মধ্যে এগুলি প্রচুর দেখা যায়।

যে শিখা ও যজ্ঞোপবীত রক্ষার জন্য লক্ষাধিক ভারতীয় বিধর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, মহারাণা প্রতাপ, বীর শিবাজী, গুরু গোবিন্দ সিংহ, ধর্মবীর হকিকত রায় প্রমুখ শত শত ভারতীয় মুসলিম শাসনের কঠিন সময়ে এগুলো রক্ষা করেছেন। কিন্তু আজকের ইংরেজিয়তার গোলাম, বাবু-টাইপের লোকেরা এই সাংস্কৃতিক প্রতীক ত্যাগ করছে। এটা কতটা দুঃখজনক!

আজকের এই ব্যক্তিরা এই অতি উপকারী ধার্মিক ও শক্তিবর্ধক প্রতীক ধারণে লজ্জা ও হীনতা বোধ করে। কিন্তু ইংরেজি দাসত্বের প্রতীক খ্রিস্টীয় পোশাক প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগে কোনো লজ্জা বোধ করে না, যা স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষতিকর এবং ভারতীয় দৃষ্টিকোণে অতি অসভ্যতার পরিচায়ক। আজকের এই তথাকথিত সভ্য ব্যক্তি যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে নারী, শিশু বা অন্য পুরুষের উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে মূত্রত্যাগ করে। অথচ, ভারতীয় পরম্পরায় মলমূত্র গোপনে, আড়ালে, নির্জনে ত্যাগের রীতি।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

প্রশ্ন: যদি শিখা না রেখে সমস্ত মাথায় লম্বা চুল রাখা হয়, তবে কী ক্ষতি হবে?

উত্তর: তালু অংশে লম্বা চুল থাকলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। ডান কানের উপরের মাথায় লম্বা চুল থাকলে যকৃতের ক্ষতি হয় এবং বাম কানের উপরের অংশে রাখলে প্লীহার ক্ষতি হয়। নারীদের শরীরের গঠন ও শরীরের বিদ্যুতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে মাথায় লম্বা চুল থাকা উচিত, তাই তাঁদের আলাদা শিখা রাখার প্রয়োজন নেই। ফ্যাশনের জন্য চুল কাটা তাঁদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই নারীদের কখনো চুল কাটা উচিত নয়।

About the author

অমৃতের পুত্র
The true seeker of Sanatan Dharma does not chase the divine in temples alone, but finds God in truth, in duty, and in the silence of the soul.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন